চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম কি জানুন

চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম

আদালতে প্রতিনিয়ত চেক ডিজঅনারের মামলা লক্ষ্য করা যায়। তাই এ বিষয়ে আমাদের কম বেশি ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাতে করে আমরা এই বিষয় সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হতে পারবো। আজকে আমরা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো সেটি হচ্ছে চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম। তাছাড়া চেক ডিজঅনার মামলার শর্তসমূহ কি, কারণ কি, সময়সীমার নতুন আইন এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের যে রায় রয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। 

সম্পূর্ণ লেখাটি পড়তে থাকুন তাহলে চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিময় সম্পর্কে জানতে পারবেন। আশা করি আপনাদের মাঝে সঠিক তথ্য দিতে পারবো। তাহলে দেরি না করে চলুন শুরু করা যাক-

Table of Contents

চেক ডিজঅনার কি?

চেক একটি বিনিময় মূল্য এটির মাধ্যমে মানুষ লেনদেন করে থাকে। যদি কোন ব্যক্তি তার নিজের ব্যাংক একাউন্ট থেকে অন্য কোন ব্যক্তিকে টাকা পরিশোধের জন্য কোন চেক ইস্যু করেন এবং উক্ত ব্যাংক একাউন্টে যদি চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণের চেয়ে কম টাকা থাকে আর চেকটি যদি ব্যাংক অপরিশোধিত অবস্থায় ফেরত দেয় তাহলে সেটি চেক ডিজঅনার হয়।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে যদি কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে টাকা প্রদান করার জন্য চেক দিয়ে থাকে। সেই চেকটি যখন ব্যাংকে জমা করা হয় তখন ব্যাংক থেকে যদি বলে, চেক দাতার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা নেই এবং চেকটি যদি ফেরত দেয় তাহলে তাকে চেক ডিজঅনার বলে। 

কি কি কারণে চেক ডিজঅনার হয়?

চেক ডিজঅনার হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন কারণে চেকের অমর্যাদা হতে পারে। নিম্নে চেক ডিজঅনারের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো।

  • আপনি যদি কোন চেক ইস্যু করেন এবং আপনার ব্যাংক একাউন্টে চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণের চেয়ে কম টাকা থাকে তাহলে চেকটি ব্যাংকে জমা করার সাথে সাথে ডিজঅনার হয়।
  • চেক প্রদানকারী ব্যক্তি চেকের উপর যে স্বাক্ষর করবেন সেই স্বাক্ষরটি যদি ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের সাথে না মেলে তাহলে চেক ডিজঅনার হয়।
  • চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণ যদি কথায় এবং অংকে লিখতে গড়মিল হয় তাহলে চেক ডিজঅনার হয়।
  • চেকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ব্যাংকে জমা করলে চেক ডিজঅনার হয়।
  • চেক পূরণ করতে ভুল হলে বা যথাযথভাবে পূরণ করা না হলে চেক ডিজঅনার হয়।
  • চেকের উপর ঘষামাজা করা থাকলেও চেক ডিজঅনার হয়। 
  • চেকের উপর যদি কাটা-কাটি থাকে তাহলে সেখানে সম্পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে সত্যকরণ না করা হয় তাহলে চেক ডিজঅনার হয়।

সাধারণত এই কারণগুলোর জন্য একটি চেক ডিজঅনার হতে পারে। এছাড়া আরো কিছু কারণ থাকেত পারে। তবে এগুলোই হচ্ছে চেক ডিজঅনার হওয়ার প্রধান কারণ।

চেক ডিজঅনার করার শর্তসমূহ

চেক ডিজঅনার করার জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে যা করতে হবে সেটি হচ্ছে চেকের উপরে যে তারিখটি লেখা আছে সেই তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে আপনাকে চেক ডিজঅনার করতে হবে। চেক ডিজঅনার করতে হলে অবশ্যই ব্যাংকিং সময়ের মধ্যে করতে হবে। 

তবে চেক প্রদানকারী ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্টে যদি পরিমাণমত টাকা থাকে তাহলে কিন্ত আপনি চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবেন না। 

চেক ডিজঅনার মামলার নিয়ম

চেক ডিজঅনার মামলা করতে হলে প্রথমে আপনাকে ব্যাংকে গিয়ে চেকটি ডিজঅনার করতে হবে। তারপর চেকের টাকা পরিশোধ করার জন্য ৩০ দিন সময় দিয়ে উকিল নোটিশ প্রেরণ করতে হবে। উকিল নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেক দাতা টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আপনাকে মামলা  দায়ের করতে হবে।

বিষয়টি সহজ করে বলতে গেলে চেক গ্রহণকারী ব্যক্তি চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয়টি জানার পর ১৩৮ ধারায় ৩০ দিন সময় দিয়ে চেক দাতাকে উকিল বা লিগ্যাল নোটিশ দেবে।

৩০ দিনের মধ্যে চেক দাতা চেকে উল্লেখিত অংকের টাকা চেক গ্রহীতাকে পরিশোধ করতে না পারলে তার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেক গ্রহীতা প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে।

চেক ডিজঅনার মামলা করতে কি কি কাগজ লাগে?

চেক ডিজঅনার মামলা করতে বেশ কিছু কাগজপত্র বা ডকুমেন্টস প্রয়োজন হয়। নিম্নে এ সকল কাগজপত্র সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো। 

  • বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি
  • চেক ডিজঅনারের স্লিপ।
  • লিগ্যাল নোটিশ বা উকিল নোটিশের কপি
  • চেক ইস্যুর তারিখ
  • চেক দাতার নাম ও তথ্য
  • চেক ডিজঅনার হওয়ার তারিখ
  • চেক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য যেমন- ব্যাংকের নাম, শাখার নাম, একাউন্ট নম্বর, চেক নম্বর ইত্যাদি
  • চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণ
  • মূল চেক
  • প্রাপ্তি রশিদ

আপনি যদি চেক ডিজঅনার মামলা করতে চান তাহলে আপনাকে উক্ত কাগজপত্র এবং তথ্যগুলো প্রদান করতে হবে। 

চেক ডিজঅনার মামলা করার সময়সীমা

চেক গ্রহীতার চেকটি ব্যাংক থেকে অপরিশোধিত হয়ে ফেরত আসার ৩০ দিনের মধ্যে চেক দাতাকে টাকা পরিশোধ করার জন্য লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে হবে। চেক দাতা ৩০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেক ডিজঅনার মামলা করতে হবে।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, লিগ্যাল নোটিশ দেয়ার পর ৩০ দিন শেষ না হতেই মামলা করা যায় কি না। হ্যা, আপনি মামলা করতে পারবেন। তবে উচিত হবে আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে মামলা করা এবং সঠিক সময় আশার আগে মামলা না করা।

আবার দেখা যায় লিগ্যাল নোটিশ দেয়ার ৩০ দিন পর যখন মামলা করতে হবে তখন কোন না কোন কারণ বসত মামলা করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে কি করণীয়? 

এমন হলে পুনরায় চেকটি ব্যাংক থেকে ডিজঅনার করাতে হবে। তারপর আবার লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে হবে। লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোর ৩০ দিন পর মামলা দায়ের করা যাবে।

চেক ডিজঅনার মামলার নতুন নিয়ম

পূর্বে চেক ডিজঅনার মামলা হলেই চেক দাতাকে সাজা দেয়া হতো। কিন্ত বর্তমানে সেই আইনের পরিবর্তন করা হয়েছে। চেক গ্রহীতা আদেও টাকা পাবে কি না সে বিষয়টি আগে দেখা হতো না। এখন চেক গ্রহীতাকে প্রমাণ করতে হবে যে, চেক দাতা এবং চেক গ্রহীতার মধ্যে যে লেনদেন হয়েছে সে সম্পর্কে বৈধ কোন চুক্তি ছিলো কি না।

চেক গ্রহীতা যদি চেক গ্রহণের বা লেনদের বৈধ কোন প্রমাণ না দিতে পারেন তাহলে কিন্ত চেক দাতার কোন সাজা হবে না। ভবিষ্যতে যাতে কোন প্রকার ঝামেলা না হয়, তাই ছোট বড় যে কোন প্রকার লেনদেন করার সময় বৈধ চুক্তিপত্র সম্পাদন করে নেয়া জরুরী।

চেক ডিজঅনার মামলা কোথায় করবেন

চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করতে হয় চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। আপনি যদি মেট্রোপলিটন এলাকায় বসবাস করেন তাহলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চেক ডিজঅনার মামলা করবেন।

আর যদি আপনি মোট্রোপলিটন এলাকার বাইরে বসবাস করেন তাহলে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালাতে চেক ডিজঅনার মামলা করবেন।

মামলা দায়ের করার পর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত / মোট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি প্রস্তুত করে বিচার কার্যের জন্য দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেবেন। চেক ডিজঅনার মামলার বিচারের কাজ কখনো চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত / মোট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা হয় না। 

চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত / মোট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধার ২০০ ধারা অনুযায়ী মামলাটি পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেন এবং যদি দেখেন এটি একটি প্রকৃতই চেক ডিজঅনার। সেই অনুযায়ী তিনি মামলাটি আমলে নেন এবং প্রস্তুত করেন তারপর বিচারের জন্য দায়রা আদালতে প্রেরণ করেন। 

চেক ডিজঅনার মামলা সম্পর্কে হাইকোর্ট রায়

১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন বা এন আই এ্যাক্ট এর ১৪১ এর (ঘ) ধারা অনুযায়ী চেক ডিজঅনারের মামলা বিচার করতে পারবেন দায়রা আদালাত। অর্থাৎ দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ, যুগ্ম দায়রা জজ এবং এত দিন পর্যন্ত এটিই হয়ে আসছে। তবে সস্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগ এই রায় সম্পর্কে বলেছেন যে, এখন থেকে চেক ডিজঅনার মামলার কার্যক্রম যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে হবে।

চেক ডিজঅনার মামলা শুধু যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে শুনানী হবে এবং যে রায় হবে সেই রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে আপিল করা যাবে। পূর্বে আপিল করার জন্য হাইকোর্টে যেতে হতো। কিন্ত বর্তমানে আইনটি সংশোধিত হয়েছে। 

চেক ডিজঅনার এর শাস্তি কি?

চেক ডিজঅনার মামলায় বাদী, বিবাদী উভয়ের মনেই এ প্রশ্ন আসতে পারে যে, দো'ষী সাব্যস্ত হওয়ার পর  কি সাজা হবে? এন আই এ্যাক্ট এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ১ বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত কারা'দন্ডে দন্ডি'ত হতে পারে অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুণ পরিমাণ অর্থ দ'ন্ডে দন্ডি'ত হতে পারে অথবা উভয় দ'ন্ডে দন্ডি'ত হবে। 

পরিশেষে

পরিশেষে বলা যায় চেক ডিজঅনার হলে সেটি একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। তাই যদি কাউকে চেক প্রদান করতে হয় তাহলে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন যেন সেটি ডিজঅনার না হয়। তাছাড়া কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক লেনদেন করার সময় অবশ্যই বৈধ চুক্তিপত্র সম্পাদন করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরণের কোন সমস্যা হলে মামলার সময় সহজে প্রমাণ করা যায়।

এই ছিলো চেক ডিজঅনার মামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য। আশা করি সকলে বুঝতে পেরেছেন। আপনি যদি এ ধরণের কোন সমস্যায় থাকেন কিংবা আরো ভালো করে বিষয়টি বুঝতে চান তাহলে অবশ্যই কোন আইজীবির পরামর্শ নিতে পারেন। 

সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন