ভূমি জরিপকালে ভূমি মালিকের করণীয় কি জানুন

ভুমি জরিপ কালে ভুমির মালিকের করণীয়

ভূমি জরিপকালে একজন মালিকের বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে লক্ষ্য রাখতে হয়। অন্যথা বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই ভূমি জরিপকালে ভূমির মালিকের করণীয় কি সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করেত চলেছি। আশা করি আপনার এ বিষয়ে জানার জন্য সম্পূর্ণ লেখাটি পড়বেন। কারণ ভূমি জরিপ ভূমি মালিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভূমি জরিপকালে জমির মালিকানার কাগজপত্র ও দখলের উপর ভিত্তি করে খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়।

কোন এলাকায় ভূমি জরিপ করার পূর্বে ভূমি প্রশাসন সেই এলাকার জনগণকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অবহিত করে থাকে। তারপর নির্ধারিত তারিখে সেই এলাকায় ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ সরেজমিনে এসে ভূমি মেপে ভূমি জরিপ কার্যক্রম করে থাকে। ভূমি জরিপ কার্যক্রমে সাধারণত দুইটি কাজ করা হয়। একটি হচ্ছে খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় আর একটি হচ্ছে মৌজা ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়।

Table of Contents

খতিয়ান কি?

খতিয়ান বলতে জমির মালিকানা প্রমাণের জন্য সরকারের যে দলিল তাকেই সাধারনত খতিয়ান বলা হয়। সরকার এই খতিয়ানের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে কোন ব্যক্তির কাছে ভূমিটি রয়েছে, ভূমির প্রকৃতি কি, ভূমির খাজনা কত টাকা দিতে হবে ইত্যাদি। মূলত সরকার একটি ভূমির সার্বিক দিক সম্পর্কে এই খতিয়ানের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ৪ ধরণের জরিপ কার্যক্রম হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- 

  • সি এস জরিপ কার্যক্রম
  • এস এ জরিপ কার্যক্রম
  • আর এস জরিপ কার্যক্রম
  • বি এস জরিপ কার্যক্রম যেটি কিছু কিছু এলাকায় এখনো চলমান রয়েছে এবং
  • বি ডি এস (BDS) নামে আরো একটি জরিপ কার্যক্রম বর্তমানে শুরু হয়েছে।

মৌজা ম্যাপ কি?

দেশের প্রত্যেকটি উপজেলাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি ভাগের জন্য একটি করে নকসা বা মানচিত্র তৈরী করা হয়। এই নকসায় জমির সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং একটি দাগ নম্বর দেয়া হয়।

ভূমি জরিপকালে ভূমির মালিকদের করণীয়

ভূমি জরিপের কাজ শুরু হওয়ার আগে এবং জরিপের সময় প্রতিটি ভূমি মালিকের কিছু কাজ করতে হয়। যাতে জরিপের সময় কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই জমি-জমা নিজের নামে রেকর্ড হয়ে যায়। নিম্নে ভূমি মালিকদের করণীয় কি সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হলো-

  • ভূমি জরিপকালে ভূমির মালিকের সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে পূর্ব থেকে ভূমির আইল বা সীমানা নির্ধারণ করে রাখা। যাতে ভূমি জরিপ করার সময় সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ সরেজমিনে ভূমিতে এসে ভূমি মেপে আপনার ম্যাপ প্রস্তুত করতে পারে।
  • জমির মালিকানার কাগজপত্র হালনাগাদ করে রাখতে হবে। আপনি যদি জমিটির ক্রয় সূত্রে মালিক হয়ে থাকেন। তাহলে জমির দলিল এবং ক্রয় করার পরে যে নামজারি বা খাজনা খারিজ করেছেন সেই খাজনার হালনাগাদকৃত কপি লাগবে। প্রয়োজন অনুযায়ী জমির বায়া দলিল এবং যে বায়া খতিয়ানগুলো রয়েছে সেগুলো লাগবে। তাছাড়া আপনি যদি ওয়ারিশন সূত্রে সম্পত্তির মালিক হয়ে থাকেন তাহলে বন্টন নামা দলিলসহ ওয়ারিশন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অবশ্যই হালনাগাদ করে রাখতে হবে।
  • জমি নিয়ে যদি কোন বিরোধ থাকে, এবং কোর্টে যদি মামলা থাকে। তাহলে সেই মামলা মকদ্দমার কাগজপত্র সংঙ্গে রাখতে হবে।
  • আমিনকে আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করে রেকর্ড প্রস্তুত করতে সহায়তা করতে হবে। যদি কোন ডিসপুট হয় সেক্ষেত্রে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আপনাকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত অফিসে ডিসপুট দায়ের করতে হবে। 
  • মালিকানার কাগজপত্র তফসীল অফিসারকে দেখিয়ে তার নিকট থেকে সত্যায়িত করে রাখতে হবে।
  • জমির পরিমাপে যদি কম হয় তাহলে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে পুনরায় পরিমাপের জন্য আবেদন করা।

উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। যাতে ভূমি জরিপের সময় কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই রেকর্ডী জরিপ কার্যক্রমটি সম্পন্ন হয়।

ভূমি জরিপে ভুল হলে করণীয়

ভূমি জরিপের পর আপনার যে খসড়া খতিয়ানটি প্রস্তুত হবে সেই খসড়া খতিয়ানে যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি হয় কিংবা সম্পত্তি যদি কম হয় তাহলে অবশ্যই আপনাকে মিসকেস দায়ের করতে হবে।

মিসকেসে যদি আপনি সংক্ষুব্ধ হন তাহলে মিসকেসের আদেশের বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনাকে আপিল করতে হবে। এই আপিলের কেসের রায়েও যদি আপনি সংক্ষুব্ধ হন তাহলে ফাইনাল গেজেট পর্চা বের হওয়ার পরে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে মামলা করে আপনাকে এই খতিয়ানটি সংশোধন করে নিতে হবে।

ফাইনাল বা প্রিন্টেড পর্চা বের হয়ে যাওয়ার ১ থেকে ৩ বছরের মধ্যে সরকার গেজেট দিয়ে বলে দেয় মৌজার যে প্রিন্টেড পর্চা দেয়া হয়ছে সেই পর্চায় যদি কারো কোন ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে তাহলে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনেলে ২০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে ভুল খতিয়ান সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে হবে। 

এখন দেখা গেলো আপনি জানেন না যে আপনার খতিয়ানে ভুল রয়েছে অথবা যখন জরিপ কার্যক্রম হয়েছে তখন আপনি এলাকায় বা দেশে ছিলেন না। দেশের বাইরে থেকে এসে দেখেন যে আপনার নামীয় সম্পত্তি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে এবং ল্যান্ড সার্ভে  ট্রাইবুনালে যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রেকর্ড সংশোধনের মামলা দায়ের করতে হয় সেই সময়ও ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। সেখেত্রে আপনি আপনি কি করবেন?

এমন হলে আপনি আপনার জমির সকল কাগজপত্র নিয়ে একজন বিজ্ঞ আইনজীবির সাথে কথা বলবেন এবং অবশ্যই দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হয়ে ভুল রেকর্ডটি সংশোধনের জন্য একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করতে হবে।

দেওয়ানী মামলার যে প্রক্রিয়া রয়েছে সেই প্রক্রিয়াগুলো সম্পূর্ণ করার পরে সবকিছু যদি ঠিক থাকে। আপনার মালিকানার কাগজপত্র যদি ঠিক থাকে, আপনি সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে যদি সেটি প্রমাণ করতে পারেন যে ভুলক্রমে আপনার নামীয় সম্পত্তিটি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে। তাহলে দেওয়ানী আদালত অবশ্যই আপনাকে ডিগ্রি প্রদান করবেন। এই ডিগ্রির কপি দিয়ে আপনাকে ভুল খতিয়ানটি সংশোধন করতে হবে।

দেওয়ানী আদালত থেকে আপনি যখন রায়ের ডিগ্রি পাবেন এই ডিগ্রির সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করে একজন বিজ্ঞ আইনজীবির মধ্যমে অথবা আপনি নিজেই এসি ল্যান্ড অফিস বা সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসে গিয়ে ভুল খতিয়ানটি সংশোধন করার জন্য আরেকটি মিসকেস দায়ের করতে হবে। 

সেই মিসকেসের সকল প্রক্রিয়া শেষ করার পরে সবকিছু ঠিক থাকলে এসি ল্যান্ড মহোদয় আপনার ভুল খতিয়ানটি সংশোধন করে দেবেন। ভুল খতিয়ানটি সংশোধন করা হলে সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড অফিস সেই খতিয়ানের একটি অনুলিপি আপনার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও রেকর্ড রুমে প্রদান করবেন। রেকর্ড রুমে যে মূল ভলিউম বই থাকবে সেই ভলিউম বই থেকেও আপনার ভুল খতিয়ানটি সংশোধন করতে হবে। 

পরিশেষে

পরিশেষে বলা যায় যে, ভূমি জরিপের সময় যাতে কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই আপনি সম্পত্তির রেকর্ড নিতে পারেন সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। উপরোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করে আপনি সঠিকভাবে আপনার জমির জরিপটি করতে পারবেন এবং আপনার নামের খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ সঠিকভাবে প্রস্তুত করে নিতে পারবেন। তাছাড়া খসড়া খতিয়ানে যদি কোন ভুল পরিলক্ষিত হয় তাহলে সেটি দ্রুত সংশোধন করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

ভূমি জরিপকালে ভূমির মালিকের করণীয় কি এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আপনাদের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনাদের উপকারে আসবে। এ বিষয়ে যদি আরো তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই কোন বিজ্ঞ আইনজীবির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।  লেখাটি যদি ভালো লাগে তাহলে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করার জন্য অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ..!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন